স্বপ্ন শূন্যতা এবং
(পর্ব ০৪)
উপমন্যু রায়
চার
দিনটা রবিবার। স্বাভাবিক কারণেই যযাতিদার অফিস ছুটি।
তখন দুপুর। খাওয়াদাওয়ার পর যযাতিদার সঙ্গে দেখা করতে তাঁর ফ্ল্যাটে গেল কুশল। দরজার সামনে পৌঁছে কলিং বেল টিপল।
কয়েক মুহূর্ত পরে দরজা খুললেন সংযুক্তা বউদি। হেসে বললেন, ‘‘আয়।’’
ভিতরে ঢুকে হাসিমুখে কুশল জানতে চাইল, ‘‘যযাতিদা নেই?’’
ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ করে সংযুক্তা বউদি বললেন, ‘‘একটু বেরিয়েছে। চলে আসবে।’’
ফ্ল্যাটের ভিতর সরু একটা পথ। তার পরই একটা কমন রুম। বেশ সাজানো। এক ধারে টিভি। একটু দূরে পর পর সোফা আর টেবিল পাতা। টেবিলে একটা ফুলদানি। তাতে সুন্দর করে ফুল রাখা। কয়েকটা ম্যাগাজিনও রয়েছে টেবিলে। বেশির ভাগই মহিলাদের ম্যাগাজিন।
খুব সুন্দর লাগছে ঘরটাকে। চেয়ারও পাতা রয়েছে কয়েকটা। ঘরের অন্য ধারে খাবার টেবিল। সেটিকে ঘিরে চারদিকে ছটি চেয়ার পাতা। কুশল গিয়ে সোফায় বসল। টেবিল থেকে একটা ম্যাগাজিন তুলে নিল।
সংযুক্তা বউদি কিচেনের দিকে চলে গেলেন।
কুশল ম্যাগাজিনের পাতা উলটে দেখতে থাকে। কয়েকটা রচনার হাইলাইট করা অংশগুলির দিকে চোখ বোলায়। ছবিও দেখে।
সংযুক্তা বউদি হাতে দু–কাপ কফি নিয়ে এসে হাজির হলেন তার সামনে। তার হাতে একটা কাপ তুলে দিয়ে বললেন, ‘‘নে, কফি খা।’’
হালকা ধোঁয়া উঠছে কফি থেকে। গরম দেখে কফির কাপটা টেবিলের ওপর রাখল কুশল। সংযুক্তা বউদি তার পাশে বসে নিজের হাতে থাকা কাপে চুমুক দিলেন। বললেন, ‘‘বল, তোর কথা বল।’’
কুশল হেসে বলে, ‘‘আমার আবার নতুন কথা কী? সবই তো জানো।’’
সংযুক্তা বউদি হাসিমুখে বললেন, ‘‘সে কী রে? তুই তো চার–পাঁচদিন পর এলি! এর মধ্যে কোনও কথা জমিয়ে রাখিসনি আমার জন্য!’’
কফির কাপটা টেবিল থেকে তুলে নিল কুশল। হেসে বলল, ‘‘একটা ঘটনা অবশ্য ঘটেছে।’’
সংযুক্তা বউদি জানতে চাইলেন, ‘‘কী ঘটনা?’’
প্রুফ দেখার টাকা নিয়ে সুজনদার প্রতারণার কথা সংযুক্তা বউদিকে পুরোটা বলল সে।
সব শুনে সংযুক্তা বউদি বললেন, ‘‘বলিস কী? অতগুলো টাকা তুই ছেড়ে দিয়ে চলে এলি!’’
কুশল একটু গম্ভীর গলায় বলল, ‘‘কী করব বলো? সুজনদা ও–ভাবে যখন হিসাবে গোলমাল করলেন, তখনই বুঝতে পারলাম, ইচ্ছে করেই তিনি ওই গোলমাল করেছেন। অর্থাৎ, সুজনদা টাকা দেবেন না। তাই চেঁচামেচি শুরু করে দিলেন। সেইজন্য আর কিছু বললাম না।’’ থেমে গেল কুশল।
সংযুক্তা বউদি তাকিয়ে রইলেন তার দিকে।
ফের গম্ভীর গলায় বলল কুশল, ‘‘যদি সত্যিই সুজনদার হিসাবে গোলমাল হত, তা হলে তিনি আমার সঙ্গে হিসাবটা মিলিয়ে কোথায় ভুল হয়েছে, বুঝে নিতে চাইতেন। আমার, না তাঁর, কার হিসাবে ভুল হয়েছে, তা খুঁজে বের করতেন। কিন্তু, তা না করে আমাকেই চোর বানিয়ে দিলেন!’’ একটু থেমে সে ফের বলল, ‘‘তাই আর কথা বাড়াইনি। কথা বাড়িয়েই বা কী হত? আমিই বা কী করতাম? ঝগড়া করতাম? মারামারি করতাম? লাভ হত? তা ছাড়া, ঝগড়া বা মারামারি তো আমি করতে পারি না!’’
সংযুক্তা বউদি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘‘অতগুলো টাকা মার গেল!’’ কুশলের জন্য সত্যিই মায়া হয় তাঁর। ছেলেটা যে ভাবে প্রতিকূল অবস্থার সঙ্গে যুদ্ধ করে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে চেষ্টা করছে, তার মধ্যে এমন ভাবে প্রতারিত হওয়ার কথা শুনলে সত্যিই খারাপ লাগে।
কুশলেরও মন খারাপ হয়ে যায় সংযুক্তা বউদির কথায়। বলে, ‘‘হ্যাঁ, আমার হয়তো কপালটাই খারাপ!’’
কুশলের মাথায় হাত রাখেন সংযুক্তা বউদি। মুখে অদ্ভুত একটা মায়া ফুটে ওঠা তাঁর।
কুশলেরও চোখ এড়ায় না তা। তাকিয়ে দেখে। চোখ নামিয়েও নেয় তার পর।
সংযুক্তা বউদি তাকিয়ে থাকেন তার দিকে। তার পর আপন মনেই অদ্ভুত এক মায়াবী গলায় বলে ওঠেন—
‘‘ফুলরা জানত যদি আমার হৃদয়
ক্ষতবিক্ষত কতখানি,
অঝোরে ঝরত তাদের চোখের জল
আমার কষ্ট আপন কষ্ট মানি।
নাইটিংগেল আর শ্যামারা জানত যদি
আমার কষ্ট কতখানি–কতদূর
তা হলে তাদের গলায় উঠত বেজে
আরও বহু বেশি বিষাদী সুর।
সোনালি তারারা দেখত কখনও যদি
আমার কষ্টের অশ্রুজলের দাগ
তা হলে তাদের স্থান থেকে নেমে এসে
জানাত আমাকে সান্ত্বনা ও অনুরাগ।
তবে তারা কেউ বুঝতে পারে না তা—
একজন, শুধু একজন, জানে আমার কষ্ট কতো,
আমার হৃদয় ছিনিয়ে নিয়েছে যে
ভাঙার জন্য— বারবার অবিরত।’’
কফি খাওয়া হয়ে গিয়েছে কুশলের। টেবিলে কাপটা রাখে। মুখ তুলে মুগ্ধ চোখে তাকায় সংযুক্তা বউদির দিকে।
সংযুক্তা বউদি হাসিমুখে বললেন, ‘‘কবিতাটা হেনরিক হাইনের।’’
কুশল কোনও জবাব দেয় না।
সংযুক্তা বউদি বললেন, ‘‘তবে এই অনুবাদ করেছিলেন হুমায়ুন আজাদ। তিনি বাংলায় কবিতাটির নাম দিয়েছেন ‘ফুলেরা জানত যদি’।’’ কফির কাপে চুমুক দেন তিনি।
কুশল চুপ করে থাকে।
সংযুক্তা বউদি তাকান তার দিকে।
কুশল বোঝে তার কথা শুনে খুব কষ্ট পেয়েছেন তিনি। তাই কবিতার মাধ্যমে সে কথা প্রকাশ করলেন। সংযুক্তা বউদি এ–রকমই। আজকের দিনে এমন মহিলাও হয়! জানে না কুশল।
সংযুক্তা বউদিও কোনও কথা বলেন না। কফি পান করতে থাকেন।
হঠাৎই কুশল বলে, ‘‘জানো বউদি, কেন জানি না, তোমাকে আমার খুব ভালো লাগে!’’
সংযুক্তা বউদি তাকালেন কুশলের দিকে। মিষ্টি একটা হাসি সারা মুখে ছড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘‘জানি তো!’’
কুশল আর কিছু বলতে পারে না। তার মনে পড়ে যায় বছর পাঁচেক আগের কথা। হঠাৎই একদিন বিকেলে ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে কুশলের হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে সংযুক্তা বউদি বলেছিলেন, ‘‘আজ থেকে তোর সঙ্গে আমার বিশেষ সম্পর্ক। আজ থেকে আমি তোর ‘অমি স্পেশাল’। বুঝলি?’’ ‘অমি স্পেশাল’ ফরাসি শব্দ। বাংলায় এর অর্থ, বিশেষ বন্ধু।
ঘাড় নেড়েছিল কুশল। তার আগে থেকেই অনেকদিন ধরে সংযুক্তা বউদি এবং যযাতিদার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ও যোগাযোগ তার। তবে সেদিনই প্রথম সংযুক্তা বউদি বিশেষ বন্ধুত্ব পাতিয়ে ছিলেন তার সঙ্গে। সেই থেকে সংযুক্তা বউদির সঙ্গে তার ভালো একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।
এটাও একটা নতুন অভিজ্ঞতা কুশলের। ভালবাসা যে কত উদার হয়, তা সে–দিনই প্রথম বুঝতে পেরেছিল সে। যযাতিদা আর সংযুক্তা বউদির ভালবাসার তো তুলনা হয় না! তবু আলাদা করে কেন যে তার সঙ্গে সংযুক্তা বউদি বন্ধুত্ব গড়েছিলেন, তার ব্যাখ্যা খুঁজে পায়নি কুশল। সত্যিই, জীবনের কত জটিল ধাঁধার জবাব সে জানে না!
সংযুক্তা বউদি কফির কাপে চুমুক দিতে থাকেন।
কুশল চুপ করেই থাকে।
সংযুক্তা বউদি বললেন, ‘‘তবে ভয় পাস না কুশল। হেরে যাবি না কোনও দিন। যতদিন বাঁচবি, লড়াই চালিয়ে যাবি। মনে রাখিস, লড়াইটাই আসল।’’
কুশল মাথা নেড়ে বলে, ‘‘এ ছাড়া আর কী করার আছে আমার বলো?’’
কফি পান হয়ে গিয়েছিল সংযুক্তা বউদির। কাপটা টেবিলে রাখলেন তিনি। বললেন, ‘‘ঠিকই বলেছিস। সেই দিক থেকে দেখলে প্রতিটা মানুষই জানবি অসহায়! খুব অসহায়। বড়লোক, মধ্যবিত্ত, গরিব বা শক্তিমান, দুর্বল বলে এ ক্ষেত্রে কেউই বাদ নয়। আজ থেকে বহু বছর আগে গৌতমবুদ্ধ নির্মম সত্যটা অনুভব করেছিলেন, জরা, ব্যাধি, মৃত্যু একদিন সকলকেই গ্রাস করবে। কেউ তার হাত থেকে রেহাই পাবে না।’’
কুশল মাথা নেড়ে বলে, ‘‘জানি। তবে—।’’ থেমে যায় সে।
সংযুক্তা বউদি তাকান তার দিকে। জানতে চান, ‘‘তবে?’’
কুশল বলে, ‘‘তবে জানো বউদি, মাঝে মাঝে আমার খুব ক্লান্ত লাগে। নিজেকে বড় অসহায় লাগে তখন। —খুব।’’
সংযুক্তা বউদি পরম স্নেহে তাকে কাছে টেনে নেন। বলেন, ‘‘না কুশল, এভাবে কখনও ভাববি না। যখনই এ–রকম কিছু মনে হবে, তখন তোর যা ভালো লাগবে, তাই করবি। ইচ্ছে হলে সিনেমায় চলে যাবি, নয়তো কোথাও থেকে ঘুরে আসবি। যদি বই পড়তে তখন ইচ্ছে করে, তো বই পড়বি। তবু এই রকম নেতিবাচক কিছু ভাববি না।’’
কুশল কিছু বলে না। মাথা এলিয়ে দেয় সংযুক্তা বউদির কাঁধে।
সংযুক্তা বউদি সিলিংেয়র দিকে তাকান। ফের বলে ওঠেন—
‘‘নদীটির শ্বাসে
সে–রাতেও হিম হয়ে আসে
বাঁশপাতা–মরা ঘাস–আকাশের তারা,
বরফের মতো চাঁদ ঢালিছে ফোয়ারা,
ধানখেতে মাঠে
জমিছে ধোঁয়াটে
ধারালো কুয়াশা,
ঘরে গেছে চাষা,
ঝিমায়েছে এ–পৃথিবী—’’
সংযুক্তা বউদি ভালো কবিতা বলতে পারেন। তবে এবার কবিতা সম্পর্কে কিছু বললেন না। বললেন না কবির নামও। কুশলও জানতে চাইল না। তার মনে হল, হয়তো জীবনানন্দ দাশই লিখেছেন এই কবিতা। জীবনানন্দের লেখা এমন ধরনেরই হয়ে থাকে। আর সে জানে, জীবনানন্দই সংযুক্তা বউদির প্রিয় কবি। তাঁর অসংখ্য কবিতা বউদির কণ্ঠস্থ।
এমন আকালেও যে কেউ বাংলা কবিতা পড়ে ভাবা যায় না! বাংলা ভাষাটাই যখন ভারত থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে, রাজনীতির সৌজন্যে যখন ডান–বাম, সব সরকারই ভোট স্থার্থে বাঙালিকে উদার ও নিঃশেষ করে দিয়ে মহান সাজতে চাইছে, তখন সংযুক্তা বউদির মতো আধুনিক মনের মহিলারা যে এখনও বাংলা কবিতা পড়েন, ভাবতেই শিহরিত হয়ে ওঠে কুশল। একটা রোমাঞ্চ হয় তার। ভালো লাগে।
কিন্তু, আর বেশিদূর ভাবতে পারল না সে। শুনতে পেল কলিং বেলের আওয়াজ। সেই আওয়াজই তার ভাবনার জাল ছিন্ন করে দিল।
সংযুক্তা বউদি বললেন, ‘‘বোধ হয় তোর দাদা এসেছে।’’ বলেই উঠে গেলেন তিনি।
কুশল সোফায় পুরো শরীরটা এলিয়ে দিল। এ কথা অনস্বীকার্য, তার জীবন যন্ত্রণার অনেকটাই ভাগ করে নেন যযাতিদা আর সংযুক্তা বউদি। তাঁরা না থাকলে সে বোধ হয় পাগল হয়ে যেত!
সে শুনতে পেল সংযুক্তা বউদি বলছেন, ‘‘এত দেরি হল যে তোমার?’’
যযাতির গলা, ‘‘রাস্তায় জ্যাম ছিল খুব।’’
আর শুনতে পেল না তাঁদের কথা। চোখ জড়িয়ে এলো কুশলের। বুজেই ফেলল শেষ পর্যন্ত।
কমন রুমে ঢুকে কুশলকে দেখলেন যযাতিদা। বললেন, ‘‘ঘুমিয়ে পড়েছে!’’
সংযুক্তা বউদি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘চা–কফি কিছু খাবে?’’
হেসে উঠলেন যযাতিদা।
সংযুক্তা বউদি অবাক চোখে তাকালেন তাঁর দিকে। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘হাসলে কেন?’’
যযাতিদা বললেন, ‘‘কিছু না। এমনিই।’’
সংযুক্তা বউদি চোখ পাকিয়ে বললেন, ‘‘না, পাগল ছাড়া এমনি–এমনিই কেউ হাসে না।’’যযাতিদা বললেন, ‘‘আমাকে পাগল ধরে নাও।’’
সংযুক্তা বউদি বললেন, ‘‘ইয়ার্কি কোরো না। বলো—।’’
যযাতিদা হেসে বললেন, ‘‘বাঙালিই বোধ হয় পৃথিবীতে একমাত্র জাতি, যারা চা–কফি–জল, সব খায়, পান করে না। এমনকী, সিগারেটও খায়!’’
সংযুক্তা বউদি হেসে বললেন, ‘‘বাদ দাও ও–সব কথা। খাবে কি?’’
যযাতিদা চোখ পাকিয়ে বললেন, ‘‘আবার?’’
ফের হাসলেন সংযুক্তা বউদি। বললেন, ‘‘আচ্ছা, বলো পান করবে?’’
যযাতিদা হেসে বললেন, ‘‘না।’’
সংযুক্তা বউদি অন্য একটা চেয়ারে বসলেন।
যযাতিদা জানতে চাইলেন, ‘‘কুশল কখন এসেছে?’’
সংযুক্তা বউদি বললেন, ‘‘অনেকক্ষণ। আমার সঙ্গে গল্প করছিল।’’
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে যযাতিদা বললেন, ‘‘কুশলের চাকরিটা জরুরি। যদি একটা চাকরি পেয়ে যায়—!’’
সংযুক্তা বউদি বললেন, ‘‘একদম ঠিক বলেছ।’’ তার পরই কুশলকে প্রুফের কাজ নিয়ে সুজনদার প্রতারণার কথা যযাতিদাকে খুলে বললেন তিনি।
সব শুনে যযাতিদা বললেন, ‘‘এগারোশো টাকা মেরে দিল!’’
সংযুক্তা বউদি বললেন, ‘‘তুমি মুখে মুখে হিসেব করে ফেললে!’’
যযাতিদা বললেন, ‘‘অফিসে তো আমাকে কম টাকা–পয়সার হিসেব করতে হয় না! কিন্তু—।’’ একটু থেমে বললেন, ‘‘ছাড়ো ও–সব কথা। দ্যাখো, কুশলের মতো অতি সাধারণ আর বোকা ছেলেটারই টাকা মেরে দিল ওই প্রেসের মালিক!’’
সংযুক্তা বউদি কোনও প্রতিক্রিয়া জানালেন না যযাতিদার কথায়। তিনি জানেন, হয়তো সকলেই জানে, ‘বড়লোকের ঢাক তৈরি হয় গরিব লোকের চামড়ায়!’
যযাতিদা বললেন, ‘‘সোর্স থাকলে আগে সরকারি অফিসেও অনেককে চাকরির ব্যবস্থা করে দেওয়া যেত। যদিও সেটা অন্যায়, তবু কুশলের মতো একটা প্রকৃত ভালো ও শিক্ষিত ছেলের চাকরি যদি হয়, তা হলে আমার সেই অন্যায় করতে কোনও দ্বিধা হত না। সত্যি বলছি।’’ চুপ করে গেলেন তিনি।
সংযুক্তা বউদি তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলেন।
যযাতিদা বললেন, ‘‘কারণ কী জানো? কারণটা শুধু তার জন্য নয়, দেশের জন্য। দেশের ভালোর জন্য। কুশলের মতো ছেলেদের আজ দেশের খুব প্রয়োজন নাগরিক হিসেবে।’’
সংযুক্তা বউদি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘এখন কি কুশলের একটা ব্যবস্থা করে দেওয়া যায় না?’’
যযাতিদা একটু ভেবে বললেন, ‘‘এখনও যে সোর্সে চাকরি হয় না, তা নয়। তবে সেই চাকরিগুলি রাজনৈতিক দলের, বিশেষ করে যারা ক্ষমতায় থাকে, তাদের অনুগত লোকদের জন্যই যেন সংরক্ষিত!’’ হাসলেন তিনি। ফের বললেন, ‘‘এ ছাড়া তেমন প্রভাবশালী যদি কেউ হন, তিনি হয়তো পারলেও পারতে পারেন। কিন্তু, আমাদের মতো সাধারণ চাকরিজীবীদের সে ক্ষমতা নেই। থাকলে তোমাকে বলতে হত না। আমি কাউকে কিছু না বলেই কুশলের জন্য ব্যবস্থা করে ফেলতাম। আসলে, কুশলের মতো পোস্ট গ্র্যাজুয়েট এবং ভালো ছেলে চাকরি পেলে সরকারেরই লাভ। এমন শিক্ষিত ছেলেকে ব্যবহার করতে না পারাটা সরকারের একটা ব্যর্থতা বলতে পারো।’’
সংযুক্তা বউদি বললেন, ‘‘তবু দেখো না, যদি—।’’
যযাতিদা বললেন, ‘‘তোমাকে সে কথা বলতে হবে না। বললাম তো তেমন কোনও সম্ভাবনা দেখলে সবার আগে আমার কুশলের কথাই মনে পড়বে। তুমি এ ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকতে পারো।’’ একটু যেন উদাস হয়ে গেলেন তিনি। তাকিয়ে রইলেন টেবিলে রাখা ফুলদানিটার দিকে।
সংযুক্তা বউদি কিন্তু কুশলের দিকে তাকালেন। পরম নিশ্চিন্তে সে ঘুমোচ্ছে! বেকারত্ব, অভাব, কোনও কিছুর জন্য এতটুকু দুঃখ বা যন্ত্রণা তার মুখে লেগে নেই। অদ্ভুত এক প্রশান্তি ছড়িয়ে রয়েছে তার ঘুমন্ত শরীরে। অসহায় মানুষকে যে ঘুমন্ত অবস্থায় শিশুর মতো পবিত্র ও নিষ্পাপ মনে হয়, কথাটা সম্ভবত ভুল নয়! (ক্রমশ)